চারিদিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এত ষড়যন্ত্র, ইসলামের বিরুদ্ধে লেখালেখি, টিভিতেও মুসলিমদের অবমাননা, সরকারগুলোর ইসলামী দলগুলোকে মেরে শেষ করে ফেলা,  ইন্টারনেটে নবী, রাসুল (তাঁদের সকলের উপর শান্তি বর্ষিত হোক) কে অপমান করে হাজারো ওয়েবসাইট, মাযহাবে-মাযহাবে ষড়যন্ত্র, ঝগড়াঝাটি, মারামারি, ইলিউমিনাটি, সিক্রেট সোসাইটি, কন্সপিরেসি থিওরি  —এত সব ব্যাপার দেখে মুসলিমরা অনেক সময় ঘাবড়ে যায়। দিনরাত চিন্তা করতে থাকে- এত বিরাট সংঘবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে কীভাবে মোকাবেলা করবে? কীভাবে সবাইকে প্রতিহত করে নিজেদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করবে? কীভাবে ‘খিলাফত’ নিয়ে আসবে?

দিনরাত দুশ্চিন্তায় তাদের ঘুম হয় না। সারাদিন ইন্টারনেট ঘেঁটে এইসব নিয়ে পড়তে পড়তে তাদের চোখ গর্তে ঢুকে যায়। চারিদিকে এত মিথ্যা, প্রতারণা, বিরোধ, ষড়যন্ত্র দেখে তারা আশা হারিয়ে ক্যান্সার রুগীর মত শুকিয়ে যায়। নেতিবাচক কথা, চিন্তার ভারে ন্যুব্জ হয়ে যায়। এদেরকে আল্লাহ পরামর্শ দিচ্ছেন—

প্রত্যেকের আপন লক্ষ্য রয়েছে, যেদিকে সে ঘুরে দাঁড়ায়। তাই ভালো কাজে এগিয়ে থাকার জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করো। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ ﷻ তোমাদেরকে এক জায়গায় করবেন। অবশ্যই আল্লাহর ﷻ যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা আছে। [আল-বাক্বারাহ ১৪৮]

 

ইসলামের বিরুদ্ধে কে, কী করছে, এই সব নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে, আমাদেরকে প্রতিযোগিতা করতে হবে- আমরা কে, কত বেশি ভালো কাজ করতে পারি। আল্লাহ প্রত্যেককে বিশেষ লক্ষ্য দিয়েছেন। আমাদেরকে সেই লক্ষ্য উপলব্ধি করে চেষ্টা করে যেতে হবে সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করার। এর জন্য দিনের পর দিন বসে থাকলে হবে না, প্রতি মুহূর্তে প্রতিযোগিতা করতে হবে। আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে ভালো কাজে দ্রুত চেষ্টা করার জন্য তাগাদা দিয়েছেন। বসে বসে সময় নষ্ট করলে আল্লাহর ﷻ প্রতি অবাধ্যতা দেখানো হবে। আমাদের উপর থেকে আল্লাহর ﷻ দেওয়া সময়ের বরকত চলে যাবে।

 

প্রত্যেকের আপন লক্ষ্য রয়েছে, যেদিকে সে ঘুরে দাঁড়ায়

আল্লাহ ﷻ আমাদের একেক জনকে একেক লক্ষ্য দিয়েছেন। হতে পারে আমাদের কারো লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ থেকে বিদ’আহ দূর করতে কাজ করা। দেখা যাবে ছোটবেলা থেকেই সে নিজে থেকেই উপলব্ধি করেছে যে, আশেপাশের মানুষরা যা করছে, তা সত্য হতেই পারে না। অন্যরা যখন বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণ করছে, তখন সে গভীরভাবে চিন্তা করে উপলব্ধি করেছে যে, এগুলো ইসলাম হতে পারে না। ঘরে ঘরে প্রচলিত বিদ’আহ ভরা বই পড়েও অন্য সবার মতো সে নিজেকে মানাতে পারেনি যে, বইগুলোর তথ্য সঠিক। তারপর সে বড় হয়ে ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করে বুঝতে পারে কোনটা সঠিক, আর কোনটা বিদ’আহ। সাথে সাথে সে তার আশেপাশের মানুষদের মধ্যে বিদ’আহ দূর করতে নিবেদিত হয়ে যায়। আর্টিকেল, বই লেখে, লেকচার দেয়, মানুষকে যত ভাবে পারে ইসলামের সঠিক শিক্ষার দিকে ডাকে।

অথবা হতে পারে আমাদের কারো লক্ষ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষকে মসজিদমুখী করা। দেখা যাবে, তার মসজিদের প্রতি এক ধরনের প্রবল আকর্ষণ  আছে, যা অন্যদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। তার মধ্যে মানুষকে সুন্দর করে বোঝানোর, মানুষের সমস্যা কোথায়, তা উপলব্ধি করার এক বিশেষ গুণ দেখা যায়। তাই সে কার সমস্যা কোথায় তা সহজেই ধরতে পারে, আর মানুষকে মসজিদমুখী করতে ঠিক যে কথাগুলো বলা দরকার, সেগুলোই বলতে পারে।

আমাদের লক্ষ্যগুলো যে শুধুই ধর্মীয় কাজ হতে হবে, তা নয়। হতে পারে কারো ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। বড় হয়ে সে ডাক্তার হয়। সপ্তাহে একদিন গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে সে নিজেই ছুটে যায় গ্রামে-গঞ্জে। এভাবে প্রতি সপ্তাহে সে শত শত সাদাকাহ জারিয়াহ অর্জন করে নিয়ে আসে।

তাই আমাদের প্রত্যেককে উপলব্ধি করতে হবে: আল্লাহ আমাদেরকে কোন দিকে অন্যদের থেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। আমাদের কাকে, কী ধরনের সমস্যা সমাধান করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তখন আমাদেরকে সেই সুযোগ-সুবিধাগুলো কাজে লাগিয়ে, সেই সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করতে হবে। কেউ হয়তো লেখালেখিতে ভালো। কেউ হয়তো পারিবারিক সমস্যা সমাধানে অভিজ্ঞ। কেউ হয়তো একজন ভালো বক্তা। কারো হয়তো আবার মুখস্থ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। আমাদের প্রত্যকের এই আল্লাহ ﷻ প্রদত্ত গুণগুলোকে ভালো কাজে লাগাতে হবে।

চেষ্টাই আসল, গন্তব্য মুখ্য নয়

আমাদের বিরুদ্ধে যারা সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করছে, তাদেরকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। কারণ আল্লাহ এদের সবাইকে একসাথে করবেন কিয়ামতের দিন। সেদিন তাদের বিচার হবেই। তাই বিচার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়ে, আমাদের কাজ হচ্ছে: আমাদের নিজেদের লক্ষ্য উপলব্ধি করা এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা। ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করা। যে যত বেশি ভালো কাজ করবে, সে-ই জিতে যাবে। তাই যারা বুদ্ধিমান, তারা দুনিয়া নামের এই টুর্নামেন্টে ভালো কাজে অন্যদের থেকে বেশি পয়েন্টে এগিয়ে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাবে।

পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত কী অর্জন করে যেতে পারলাম, কয়টা লোককে ইসলামের পথে আনলাম, কয়টা মসজিদ বানালাম, কয়টা ইসলামিক ডিগ্রি পেলাম —সেটা লক্ষ্য নয়। আসল লক্ষ্য হলো: আমি আল্লাহর ﷻ সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালো কাজ করতে কতটুকু চেষ্টা করেছি। আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে এমন কোনো পরীক্ষা দেননি, যেখানে আমাদেরকে সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে, বা কমপক্ষে ৫০ নম্বরের সঠিক উত্তর দিতে হবে, না হলে ফেল করবো। বরং আল্লাহ ﷻ দেখেন: আমি কতখানি চেষ্টা করছি পরীক্ষায় সঠিক উত্তর দেওয়ার, এবং কত বেশি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের চেষ্টাটাই আল্লাহ ﷻ লক্ষ্য করেন। শেষ পর্যন্ত কী অর্জন করলাম, সেটা নয়। এখানেই স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির পরীক্ষার সাথে আল্লাহর ﷻ দেওয়া পরীক্ষার পার্থক্য।[১]

কুরআনের আরবি শেখার চেষ্টা করছেন গত দুই বছর ধরে, কিন্তু এখনো ঠিকমতো আরবিতে কুরআন পড়তে পারছেন না? ‘দ্বয়াল্লিন’ উচ্চারণ ‘যোয়াল্লিন’ হয়ে যাচ্ছে, ‘গ্বইরিল মাগদুবি’ উচ্চারণ ‘গ্যায়রেল মাগদুবে’ হয়ে যাচ্ছে? কুরআনের এক পাতা পড়তে আধা ঘণ্টা সময় লাগছে? —কোনো সমস্যা নেই। আল্লাহ ﷻ পরম ভালবাসায় আপনার এই হাঁটি-হাঁটি, পা-পা করে এগিয়ে যাওয়া দেখছেন। আপনার এই হাঁটার চেষ্টা, বার বার পড়ে যাওয়া, আবার উঠে দাঁড়ানো —এটার অনেক মূল্য তাঁর কাছে। গন্তব্য পৌঁছানো নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, হতাশ হবেন না। যাত্রা পথে সংগ্রাম করাটাই মুখ্য।[১]

কিছু মানুষ আছে যাদের জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই। তাদের জীবনে একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে দিনে দশ ঘণ্টা ভিডিও গেম, মুভি, কার্টুন দেখা, বন্ধুবান্ধবের সাথে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, আর এর ফাঁকে একটু-আধটু পড়াশুনা, চাকরি করা। কু’রআনে মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, প্রত্যেককেই কোনো না কোনো লক্ষ্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। আমাদের কাজ হচ্ছে সেই লক্ষ্য জলদি অনুধাবন করে, তা অর্জনে কাজ করে যাওয়া।[১]

এই আয়াতে وِجْهَةٌ শব্দটির কয়েকটি অর্থ রয়েছে, যেমন ১) মুখ, ২) দিক, ৩) উদ্দেশ্য, লক্ষ্য। অনেকে এই আয়াতের অর্থ করেছেন যে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজ নিজ কিবলা রয়েছে, আর মুসলিমদের কিবলা হচ্ছে কা’বা। আবার অনেকে এর অর্থ করেছেন: প্রত্যেকের নিজ নিজ লক্ষ্য রয়েছে, তাই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিযোগিতা করতে হবে।[৪][১১][১৪] আল্লাহই জানেন: কোন প্রেক্ষাপটে কোন অর্থ সঠিক।

অবশ্যই আল্লাহর ﷻ যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা আছে

আমরা অনেক সময় ভাবি যে, আল্লাহ ﷻ সৃষ্টিকর্তা, তাঁর তো সব ক্ষমতা থাকবেই। এটা আবার আলাদা করে বার বার মনে করিয়ে দেওয়ার কী দরকার?

কু’রআনে আল্লাহ ﷻ বার বার আমাদেরকে তাঁর অসীম ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। এর পেছনে কারণ রয়েছে। আমরা অনেক সময় মুখে স্বীকার করলেও, অন্তরে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারি না যে, আল্লাহ ﷻ আসলে সবকিছু করতে পারেন। অনেক সময় পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ, দৈনন্দিন সমস্যার চাপে পড়ে ভুলে যাই, আল্লাহর ﷻ সম্পর্কে উল্টো-পাল্টা অভিযোগ করা শুরু করি। এরকম কিছু উদাহরণ দেই—

দশ-বিশ বছর ধরে যারা বিজ্ঞান পড়েন, তাদের মধ্যে একটা সমস্যা তৈরি হয়: তারা সবকিছুকে বিজ্ঞানের নিয়মের, সূত্রের সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন। বিজ্ঞান তাদেরকে শত শত সীমা শেখায়, সবকিছুকে সেই সীমার মধ্যে চিন্তা করা শেখায়। এর ফলে একসময় তারা নিজের অজান্তেই আল্লাহকেও ﷻ সেই বিজ্ঞানের সীমার মধ্যে ফেলে দেন। বৈজ্ঞানিক ভাবে অসম্ভব, অবাস্তব কোনো কিছুকে তারা আর মেনে নিতে পারেন না। কু’রআনে কোনো অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা পড়ে প্রথমেই তাদের মনে হয়, “এখানে নিশ্চয়ই অনুবাদে বা বোঝায় কোনো ভুল আছে, কারণ এরকম অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব ঘটনা কীভাবে হতে পারে?”

যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদেরকে কিছু বৈজ্ঞানিক ধারণা দিয়ে ব্যাপারটা যে সম্ভব, তা বোঝানো হচ্ছে, ততক্ষণ তারা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেন না। এদেরকে বার বার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার— বিজ্ঞান আল্লাহর ﷻ একটি সৃষ্টি মাত্র। যিনি বিজ্ঞান সৃষ্টি করেছেন, তিনি বিজ্ঞানের বাইরে আরও অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন। তাঁর বেলায় বৈজ্ঞানিক নিয়ম, সূত্র, সীমা খাটে না।

যারা আশেপাশে নানা ধরনের মূর্তি, দেবতা দেখে অভ্যস্ত, নানা ধরনের শিরকের মধ্যে বড় হয়েছেন, তাদের অনেকের চিন্তাভাবনায় শিরক ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা অনেকে আল্লাহকে ﷻ একধরনের বড়-সড় দেবতা হিসেবে চিন্তা করেন। দেবতারা যেমন চাইলেই সবকিছু করতে পারে না, তাদের যেমন নানা ধরনের সীমা রয়েছে, তাদের কাছে কিছু চাইতে গেলে যেমন তাদের সীমাগুলো মাথায় রেখে চাইতে হয় —একসময় মানুষ নিজের অজান্তেই আল্লাহকেও ﷻ সেই সব সীমার মধ্যে ভাবা শুরু করেন। আল্লাহকে ﷻ নিয়ে তারা যা আশা করেন, সেটা একজন দেবতার ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তারা কিছু প্রত্যাশা করার সময় নিজের অজান্তেই ভাবেন, “নাহ্, আল্লাহর ﷻ পক্ষে এটা করা সম্ভব না। এটা আল্লাহর ﷻ কাছে চেয়ে কী হবে? এটা কী দেওয়া সম্ভব?”

একারণে কু’রআনে আল্লাহ ﷻ বার বার তাঁর সম্পর্কে ধারণাগুলো, তাঁর বিভিন্ন নামের, গুণের মাধ্যমে পরিষ্কার করে দেন। আমাদেরকে আল্লাহর ﷻ এই গুণগুলো, যেমন, আল-’আজিজ— সমস্ত ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব যার, আল-জাব্বার— তিনি যে কাউকে দিয়ে, যে কোনো কিছু করাতে বাধ্য করতে পারেন, আল-কাহহার— যে কোনো শক্তিকে তাঁর অধীনে বশ করতে পারেন। এরকম আল্লাহর ﷻ যে শত নাম, গুণ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে ভালো করে চিন্তা করা দরকার। এগুলো আল্লাহকে ﷻ আরও সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে আমাদের সাহায্য করবে, তাঁর সন্মানের প্রতি অপমানজনক চিন্তা-ভাবনা করা থেকে দূরে রাখবে।

সূত্র:  কুরআনের কথা

ফেসবুকে যারা মন্তব্য করেছেনঃ

(Visited 928 times, 1 visits today)