অশান্তি মানুষেরই সৃষ্টি। অশান্তি মানুষেরই কর্মফল। বিশ্বব্যাপী অশান্তি সৃষ্টি করেছে মানুষ। বর্তমান বিশ্বে বিরাজিত অশান্তির ধরণ ও রূপ বর্ণনা করে শেষ করা কঠিন। কয়েকটি বড় বড় অশান্তি নিম্নরূপ :

১. মানুষের মানসিক অশান্তি, মানসিক যন্ত্রণা ও দাহ।
২. ক্ষুধা, দারিদ্র, অভাব।
৩. মারাত্মক রোগ ও মরণ ব্যাধির বিস্তার।
৪. দাম্পত্য কলহ, বিরোধ, বিচ্ছেদ, বৈধব্য।
৫. পারিবারিক বিশৃংখলা ও চরম অশান্তি।
৬. চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুটতরাজ, জবরদখল।
৭. ঘুষ, চাঁদাবাজি।
৮. ধোকা, প্রতারণা, জালিয়াতি, ফাঁকিবাজি।
৯. হিংসা বিদ্বেষ, ঝগড়া বিবাদ, হানাহানি, খুনাখুনি।
১০. যৌতুকের যাঁতাকল।
১১. নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ব্যভিচার, যৌন হয়রানি এবং নারীর অধিকার হরণ।
১২. বেকারত্ব।
১৩. অবাধ্যতা, উশৃংখলা।
১৪. যুলুম, নির্যাতন, অন্যায়, অবিচার।
১৫. মিথ্যাবাদিতা, ওয়াদা খেলাফি, চুক্তিভঙ্গ।
১৬. দমন, নিপীড়ন, বিদ্রোহ।
১৭. আগ্রাসন, অবরোধ।
১৮. সন্ত্রাস।
১৯. যুদ্ধ।
২০. নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা।
২১. মানবাধিকার পদদলন।
২২. বিপথগামিতা।
২৩. মাদকাসক্তি/নেশা।
২৪. সম্মান ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তাহীনতা।
২৫. জীবনের নিরাপত্তাহীনতা।
২৬. হত্যা, আত্মহত্যা, অন্তর্ঘাত, নারীর জীবনাহুতি।
২৭. সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা।
২৮. খেয়ানত, অবিশ্বস্ততা, আত্মস্যাৎ।
২৯. মন্দা, উৎপাদন ঘাটতি, সম্পদের স্বল্পতা, টাকার প্রবাহ, দুস্প্রাপ্যতা।
৩০. পরিবেশ দূষণ।
৩১. অপচয় অপব্যবহার।

শুধু এগুলোই নয়, এর বাইরেও রয়েছে অশান্তির অসংখ্য ইন্ধন। আর আমাদের জানা অজানা, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য, ছোট বড় এসব অশান্তির ইন্ধনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি মানুষের মনের শান্তি, ঘরের শান্তি, সামাজিক শান্তি, রাষ্ট্রীয় শান্তি এবং বিশ্বশান্তি। সব অশান্তির জন্যে দায়ী মানুষের কর্ম :

স্থলভাগ ও জলভাগে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে মানুষের নিজেরই কৃতকর্মের দরূণ, যেনো তিনি তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করাতে পারেন। এর ফলে হয়তো তারা ফিরে আসবে। -সূরা ৩০ আর রূম : আয়াত -৪১।

সর্বব্যাপী অশান্তির কারণ

সমাজের সর্বনিন্ম ইউনিট ব্যক্তি, আর সর্বোচ্চ ইউনিট এই বিশ্ব। ব্যক্তি থেকে নিয়ে গোটা বিশ্বব্যাপী জ্বলছে অশান্তির দাবানল। এতে নিরবে এবং সরবে দগ্ধ হচ্ছে প্রায় সবাই, সর্বত্র। দগ্ধ হচ্ছে নারী, দগ্ধ হচ্ছে পুরুষ, দগ্ধ হচ্ছে শিশু। অশান্তির দহন কতো রকম এবং কতো প্রকার তা আমরা বলে শেষ করতে পারবোনা। কিন্তু দহন যে গ্রাস করে চলেছে সবাইকে সে সত্য লুকাবার সাধ্য কার?

কিন্তু কিসের কারণে এই সর্বব্যাপী অশান্তি? কারা জ্বালিয়েছে এ আগুন? কারা ঢালছে তাতে তেল ফুয়েল কাঠখড়ি? হ্যাঁ, বিশ্বগ্রাসী অশান্তির অনিবার্য কারণগুলো হলো :

১. মানুষের স্রষ্টা ও প্রভু মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি মানুষের অবিশ্বাস অস্বীকৃতি ও অবজ্ঞা।
২. আল্লাহদ্রোহীতা (আল্লাহর বিধানের প্রতি বিদ্রোহ)।
৩. আত্মার দাসত্ব (লাগামহীন কামনা বাসনা ও লালসার অনুগমন)।
৪. সীমালংঘন (Transgression)।
৫. অহংকার, দাম্ভিকতা ও আত্মম্ভরিতা।
৬. লোভ ও স্বার্থপরতা (ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা জাতীয় স্বার্থ)।
৭. নিষ্ঠুরতা, পাষন্ডতা, পাশবিকতা।
৮. অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা।
৯. পাপলিপ্সা, পাপাচার, অনাচার, কলুষতা।

যাবতীয় দুর্দশার প্রধান প্রধান কারণ হলো এগুলো। অবিশ্বাসী, অমান্যকারী, আল্লাহদ্রোহী, আত্মার দাস, সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, নির্লজ্জ, পাপাচারী নেতৃত্ব কর্তৃত্ব ও সমাজের কর্ণধারদের কারণেই পৃথিবীতে নেমে এসেছে আজ এতো অশান্তি, এতো গ্লানি, এতো দুঃখ-কষ্ট আর মানবতার প্রতি লাঞ্ছনা। এ প্রসঙ্গে দেখুন মহান আল্লাহর বাণী :

যারা কুফুরি (অর্থাৎ তাদের স্রষ্টাকে অবিশ্বাস ও অমান্য) করবে, তাদের আমি পৃথিবীর ও পরকালের জীবনে কঠোর শাস্তি প্রদান করবো এবং তারা কোনো সাহায্যকারী পাবেনা। -সূরা ৩ আলে ইমরান : আয়াত -৫৬।

তোমরা আমার প্রদত্ত পবিত্র জীবিকা থেকে আহার করো। পৃথিবীতে সীমালংঘণ করোনা। তা করলে তোমাদের উপর আমার গজব অবধারিত হয়ে যাবে। আর যাদের উপর আমার গজব অবধারিত হয় তারা ধ্বংস হয়ে যায়। -সূরা ২০ তোয়াহা : আয়াত -৮১।

ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে তোমার রায় কি- যে তার কামনা বাসনাকে নিজের প্রভু বানিয়ে নিয়েছে-? তুমি কি তার পক্ষে ওকালতির দায়িত্ব নেবে? -সূরা ২৫ আল ফুরকান : আয়াত ৪৩।

যারা আমার আয়াতকে অস্বীকার করে এবং সে সম্পর্কে অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে, তাদের জন্যে আকাশের দুয়ার উন্মুক্ত করা হবেনা এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবেনা। -সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত -৪০।

যারা বিশ্বাসীদের মধ্যে অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা প্রসারে উদ্যোগী হয়, তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পৃথিবীর জীবনে এবং পরকালেও। -সূরা ২৪ আন নূর : আয়াত ১৯।

 (তার আনুগত্য করোনা) ……. যে কল্যাণের কাজে বাধাদানকারী, সীমালংঘনকারী, পাপিষ্ঠ, রূঢ়-নিষ্ঠুর, কুখ্যাত। -সূরা ৬৮ আল কলম : আয়াত ১২-১৩।

শান্তির উৎস কোথায়?

মানুষ শান্তিদাতা নয়, মানুষ শান্তি ও মুক্তির অন্বেষী। সুতরাং শান্তির অন্বেষীদের শান্তি চাইতে হবে শান্তি ও মুক্তি দাতার কাছে। যার কাছে শান্তি আছে এবং শান্তি লাভের ফর্মূলাও আছে।

কে তিনি- যার কাছে শান্তি আছে এবং যিনি মুক্তি দিতে পারেন? এর জবাব একটাই, আর তাহলো : যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং শান্তি ও মুক্তির অন্বেষী বানিয়েছেন। শান্তি কেবল তাঁরই কাছে আছে এবং কেবল তিনিই মানুষকে শান্তি ও মুক্তি দিতে পারেন। তাঁরই নাম আল্লাহ। শান্তির চাবিকাঠি তাঁরই মুষ্টিবদ্ধে। তিনিই শান্তির উৎস এবং তিনিই মুক্তিদাতা :

 তিনিই আল্লাহ। তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ্ (ত্রাণকর্তা ও মুক্তিদাতা) নেই। তিনিই একমাত্র সম্রাট, পুত পবিত্র। তিনিই শান্তি। তিনিই প্রশান্তি ও নিরাপত্তাদাতা। তিনিই রক্ষক। তিনিই প্রবল পরাক্রমশীল মহিমান্বিত। -সূরা ৫৯ হাশর : আয়াত ২৩।

সুতরাং মানুষকে শান্তি চাইতে হবে শান্তির উৎস মহান আল্লাহর কাছে। আর শান্তি লাভের জন্য তিনি যে ফর্মূলা বা জীবন পদ্ধতি দিয়েছেন সেটার অনুসরণ ও অনুবর্তন করতে হবে। তবেই মানব জীবনে নেমে আসবে শান্তির ফল্গুধারা।

শান্তি ও মুক্তি লাভের শর্ত

এমন কিছু মৌলিক শর্ত বা গুণাবলী রয়েছে, যেগুলো গ্রহণ করা বা অর্জন করা শান্তি ও মুক্তি লাভের প্রাথমিক শর্ত। এগুলো ছাড়া কিছুতেই শান্তি ও মুক্তি লাভের পথে অগ্রসর হওয়া যায় না। সেগুলো হলো :

১. মানুষের স্রষ্টা ও শান্তির মালিক মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনকেই জীবনের         একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা।
২. বিনীতভাবে এক আল্লাহর দাসত্ব করা এবং তাঁর বিধানের আনুগত্য ও অনুসরণ করা।
৩. আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার এবং তাঁর শাস্তির প্রচণ্ড ভয় পোষণ করা।
৪. আল্লাহর পুরস্কার তথা জান্নাত লাভের দুর্নিবার আকাংখা পোষণ করা।
৫. মানবীয় ভ্রাতৃত্ববোধ এবং মানবতার হিতাকাংখা ও কল্যাণ চেতনা।
৬. আত্মপূজা, আত্মার দাসত্ব, স্বার্থপরতা ও অবৈধ কামনা বাসনা থেকে মুক্ত পবিত্র দৃষ্টিভংগি।
৭. ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের প্রাপ্তি নয়, পরকালের অনন্ত জীবনের মুক্তি আর সাফল্যই হবে জীবনবোধ ও       জীবন চেতনার মূল চালিকা শক্তি।

এই শর্তগুলো প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :

নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা নয়, যারা ঈমান আনে, আমলে সালেহ করে, সত্যের উপদেশ দেয় এবং ধৈর্যধারণের পরামর্শ দেয়। -সূরা ১০৩ আল আসর : আয়াত ২ ও ৩।

তোমার প্রভু নির্দেশ দিয়েছেন: তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করো না। -সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৩।

‘তুমি তাদের (নবীর সাথিদের) দেখতে পাচ্ছো, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ এবং সন্তুষ্টি কামনায় অবনত আত্মসমর্পিত।’ -সূরা ৪৮ আল ফাতহ : আয়াত ২৯।

আর যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে জবাবদিহিতার জন্যে দাঁড়াবার ভয়ে ভীত থাকে আর নিজেকে বিরত রাখে আত্মার (কামনা বাসনার) দাসত্ব থেকে, জান্নাতই হবে তার আবাস। -সূরা ৭৯ আন নাযিয়াত : আয়াত ৪০-৪১।

হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে করে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারো। তবে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন সে, যে তোমাদের মাঝে অধিক আল্লাভীরু। -সূরা ৪৯ আল হুজুরাত : আয়াত ১৩।

ইসলামই শান্তি এবং শান্তির আহ্বায়ক

ইসলাম শান্তির উৎস মহান আল্লাহর প্রদত্ত জীবন যাপন পদ্ধতি। মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্যেই তিনি মানুষকে এই সুন্দর জীবন যাপন পদ্ধতি উপহার দিয়েছেন। আল্লাহই শান্তির উৎস। তিনি চান মানুষ শান্তিতে থাকুক। তাই তিনি মানুষকে শান্তির বিধান দিয়েছেন এবং মানুষকে শান্তির দিকে আহ্বান করেছেন:

আল্লাহ আহ্বান করছেন শান্তির আবাসের দিকে। আর তিনি যাকে চান সরল সঠিক পথে পরিচালিত করেন। -সূরা ১০ ইউনুস : আয়াত ২৫।

শান্তির পথ প্রদর্শনের জন্যেই আল্লাহ তায়ালা রসূল পাঠিয়েছেন এবং তাঁর সাথে পাঠিয়েছেন শান্তির ম্যানুয়েল আল কুরআন :

আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে একটি আলো এবং একটি উন্মুক্ত কিতাব। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুগমণ করে, আল্লাহ তাদেরকে এর সাহায্যে পরিচালিত করেন শান্তির পথে। -সূরা ৫ মায়িদা : আয়াত ১৫-১৬।

আল্লাহর দেয়া আলো এবং উন্মুক্ত কিতাব হলো আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহর প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা। যারা আল্লাহর রসূলকে এবং তাঁর প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা বা জীবন যাপনের ম্যানুয়্যালকে অনুসরণ করবে, তাদের সমাজেই নেমে আসবে শান্তির ফল্গুধারা এবং তারাই আস্বাদন করবে মুক্তির স্বাদ :

শান্তি লাভ করবে তারাই, যারা ‘আল হুদা’ (আল্লাহ প্রদত্ত জীবন পদ্ধতি) অনুসরণ করবে। -সূরা ২০ তোয়াহা, আয়াত : ৪৭।

ইসলামই শান্তি। ইসলামের একটি অর্থ শান্তি। শান্তিকে পুরোপুরি গ্রহণ না করলে এবং শান্তির মধ্যে পুরোপুরি প্রবেশ না করলে শান্তি লাভ করা যায় না। তাই মহান আল্লাহ পরিপূর্ণভাবে ইসলাম বা শান্তির মধ্যে প্রবেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন:

হে বিশ্বাসীরা! তোমরা পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ করো ইসলামে (শান্তির মধ্যে) …। -সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২০৮।

ইসলাম তার শত্রু পক্ষ বা প্রতিপক্ষের সাথেও অশান্তি চায় না। সেজন্যেই প্রতিপক্ষ বিবাদ বা সংঘাত সৃষ্টি করতে চাইলে মুসলিমরা বলে থাকে: ‘আমরা শান্তি চাই’:

অজ্ঞরা যখন তাদের সাথে বিবাদ বিসম্বাদে জড়াতে উদ্যত হয়, তখন তারা বলে: ‘আমরা শান্তি চাই।’-সূরা ২৫ আল ফুরকান,আয়াত : ৬৩।

রসূল সা. সালাত আদায়ের পর আল্লাহর কাছে শান্তি কামনা করতেন এ ভাষায়:

: ‘হে আল্লাহ তুমিই শান্তি এবং শান্তি তোমার পক্ষ থেকেই এসে থাকে।’

ইসলামের মহান শিক্ষা হলো একজন মানুষের সাথে আরেকজনের সাক্ষাত হলে তারা পরস্পরকে বলবেঃ-

‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।’

অর্থ:আপনার/আপনাদের প্রতি শান্তি, আল্লাহর রহমত এবং তাঁর বরকত বর্ষিত হোক।’

খলিফা উমর রা. কে খেজুর গাছের তলায় গভীর প্রশান্তির ঘুমে দেখতে পেয়ে রোম সম্রাটের দূত বলে উঠেছিল :

: হে উমর! তুমি ইনসাফ করেছো, তাই ঘুমাচ্ছো প্রশান্তিতে।

শান্তি ও মুক্তির জন্যে চাই মৌলিক মানবীয় গুণাবলী

যারাই মানুষের শান্তি ও মুক্তি নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে, তাদের মধ্যে অবশ্যই নিম্নোক্ত পনেরটি মৌলিক মানবীয় গুণ বা এর অধিকাংশ বর্তমান থাকতে হবে। এগুলো নিরপেক্ষ মানবীয় গুণাবলী। এগুলো ছাড়া অশান্তি সৃষ্টির কাজও করা যায় না, শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও নেয়া যায় না। গুণগুলো হলো:

১. সুস্পষ্ট জীবন-লক্ষ্য ও জীবন-উদ্দেশ্য।
২. নির্দিষ্ট জীবন-পদ্ধতি (life style) অনুসরণ।
৩. দুর্দান্ত সাহস আর অপরিসীম বীরত্ব।
৪. প্রবল হৃদয়াবেগ, স্বপ্নসাধ, মনোবাসনা ও উচ্চাশা।
৫. দৃঢ়তা, অটলতা ও অবিচলতা।
৬. পরিশ্রম প্রিয়তা।
৭. সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা।
৮. সতর্কতা, দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টি।
৯. উদ্ভাবনী ক্ষমতা।
১০. সিদ্ধান্তগ্রহণ শক্তি।
১১. পরিস্থিতির অনুকূল কর্মপন্থা গ্রহণের বিচক্ষণতা।
১২. প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা।
১৩. ঐক্য, সংহতি ও সংঘবদ্ধতা।
১৪. বলিষ্ঠ ও প্রভাব বিস্তারকারী নেতৃত্ব।
১৫. টীম স্পীরিট।

শান্তি ও মুক্তি নিশ্চিত করার অনিবার্য গুণাবলী

এমন কতিপয় মানবীয় গুণাবলী আছে, যেগুলো উপরে উল্লেখিত মৌলিক মানবীয় গুণাবলীকে কল্যাণমুখী করে দেয়ার জন্য অনিবার্য। উপরোক্ত গুণাবলীর সাথে যাদের মধ্যে নিম্নোক্ত কল্যাণমুখী মানবীয় গুণগুলো যুক্ত হবে, তারাই হবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত মানবগোষ্ঠী। গুণগুলো হলো :

১. সত্যবাদিতা ও সত্যপ্রিয়তা।
২. বিশ্বস্ততা ও নির্ভরযোগ্যতা।
৩. ন্যায়পরায়নতা, সুবিচার ও নিরপেক্ষতা।
৪. মানবতাবোধ ও উদার প্রশস্ত হৃদয়- মন।
৫. আত্মসম্মানবোধ।
৬. দয়া, অনুগ্রহ, বদান্যতা ও সহানুভূতি।
৭. প্রতিশ্রুতি পালন।
৮. ভদ্রতা, শিষ্টাচার ও সৌজন্যপ্রিয়তা।
৯. আত্মসংযম।
১০. নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা।
১১. নির্মল নিষ্কলুষ মন ও আদর্শপ্রিয়তা।
১২. নিঃস্বার্থপরতা।
১৩. সদিচ্ছা।
১৪. মঙ্গলাকাংখা ও কল্যাণকামিতা।
১৫. আত্মমূল্যায়ন।

বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে সামষ্টিকভাবে এসব মৌলিক এবং অনিবার্য মানবীয় গুণাবলীর প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। সে কারণে মানবতার মুক্তি এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

পক্ষান্তরে অন্যদের মধ্যে মৌলিক মানবীয় গুণাবলী বর্তমান থাকার সাথে সাথে অশান্তি সৃষ্টির কারণগুলো (উপরে বর্ণিত) বিদ্যমান থাকায় বিশ্ববাসী আজ অশান্তির কারাগারে বন্দী।

তাই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজন, মৌলিক মানবীয় গুণাবলী এবং অনিবার্য সহায়ক গুণাবলীতে বলীয়ান একদল সুশৃঙ্খল মানব। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা এবং তাঁর আনুগত্য ও দাসত্বের চেতনায় মানব কল্যাণে তারা থাকবে সদা উজ্জীবিত :

মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা উত্তম কাজের আদেশ করে, মন্দ কাজ নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে। এরাই ঐসব লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ অচিরেই দয়া ও অনুকম্পা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়। -সূরা ৯ আত তাওবা : আয়াত -৭১।

নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ, মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ, মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ, ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালণকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী, তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার। -সূরা ৩৩ আল আহযাব : আয়াত -৩৫।

 

মুক্তি ও সাফল্যের অর্থ

আল কুরআনের দৃষ্টিতে মানব জীবন অখণ্ড এবং দুনিয়া ও আখিরাত পরিব্যাপ্ত। পার্থিব জীবনে মানুষের দৈহিক মৃত্যু হলেও মানুষের আত্মার মৃত্যু হয় না। মানব জীবনকে পরকালেও মৃত্যুহীন রাখা হবে।
মানুষের পার্থিব জীবন খুবই হ্রস্ব এবং স্বল্প সময়ের। অপরদিকে আখিরাতের জীবন অনন্ত, মৃত্যুহীন :

নিশ্চয়ই এই পৃথিবীর জীবন একটা খেল তামাশার সময় মাত্র। অথচ আখিরাতের জীবন চিরন্তন। -সূরা ২৯ আনকাবুত : আয়াত -৬৪।

কুরআন বলে, মানুষের এই পৃথিবীর ক্ষুদ্র জীবনটা হলো : প্রচেষ্টার, বিনিয়োগের, চাষবাষ ও বীজ বপনের। অপরদিকে আখিরাতের জীবন হলো : ফসল কাটার, ফল লাভের এবং ফল ভোগের।

পৃথিবীর জীবনে যার প্রচেষ্টা যেমন হবে, বিনিয়োগ যেমন হবে, যে ফলের বীজ সে বপন করবে, আখিরাতের জীবনে সেই রকম ফল ফসলই সে লাভ করবে এবং সেই ফল ফসলই সে ভোগ করবে।
তাই কুরআন বলে, পৃথিবীর ক্ষুদ্র জীবনটাকে চূড়ান্ত আবাস এবং ভোগের জায়গা বানিয়ো না, বরং আখিরাতের মুক্তি, সাফল্য ও সুফল লাভের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রাখো। আখিরাতের জীবনের মুক্তি ও সাফল্যের লক্ষ্যে পৃথিবীর জীবনে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালাও, এর জন্যে ত্যাগ স্বীকার করো, এরি জন্যে জীবন লক্ষ্যকে একমুখী করে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাও, তবেই তুমি তোমার আখিরাতের সীমাহীন জীবনে মুক্তি ও সাফল্যের জয়মাল্যে ভূষিত হবে :

আর যারা আখিরাতের মুক্তি ও সাফল্যের সংকল্প করে এবং এর জন্যে যেমন চেষ্টা সাধনা করা দরকার তা করে যায়, তারা যদি মুমিন হয়, তাহলে এমন লোকদের চেষ্টা সাধনা (আল্লাহর নিকট) অবশ্যি কুবল হবে। -সূরা ১৭ বনি ইসরাইল : আয়াত -১৯।

ইসলাম বলে, মানুষের জীবন অবিনাশী। দৈহিক মৃত্যুর মাধ্যমে তার জীবনটা স্থানান্তরিত হয় মাত্র। পৃথিবীর জীবন তার গোটা জীবনের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তাই পার্থিব জীবনের কল্যাণ প্রচেষ্টা যেমন তার জন্যে জরুরি, তেমনি, বরং তার চাইতে বেশি প্রচেষ্টা চালাতে হবে আখিরাতের অনন্ত জীবনের মুক্তি, সাফল্য ও কল্যাণের জন্যে। এ কারণেই কুরআন উভয় জগতের কল্যাণের জন্যে দোয়া করতে শিখিয়েছে :

আমাদের প্রভু! এই জগতেও আমাদের কল্যাণ দাও এবং পরজগতেও আমাদের কল্যাণ দাও। আর জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদের মুক্তি দিও। -সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত -২০১।

লক্ষ্য অর্জনের পথে মানুষ যতো কষ্টই করুক না কেন, তাতে রয়েছে আনন্দ ও প্রশান্তি। সুতরাং মুক্তি ও সাফল্যের অর্থ হলো :

  • পরকালের অনন্ত জীবনে আল্লাহর পাকড়াও এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি।
  • পরকালের অনন্ত জীবন আল্লাহর সন্তোষ আর জান্নাতের সুখ বিলাসের মধ্যে অবস্থানের সুযোগ লাভ।
  • পৃথিবীর জীবনে সকলের দাসত্ব ও শৃঙ্খল পরিহার করে এক আল্লাহর দাস হিসেবে প্রশান্তির জীবন যাপন করা।
  • এই বিশেষ ধরনের জীবন যাপনের কারণে এ পথে যেসব দুঃখ কষ্ট ও বিপদ মুসিবত আসে সেগুলোকে বৃহৎ মুক্তির লক্ষ্যে স্বাভাবিক বলে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়া। যেমন সন্তানের জন্যে মায়ের কষ্ট। প্রিয়জনের জন্যে প্রিয়জনের কষ্ট। এই ধরনের কষ্টের জন্যে দুঃখ থাকে না, থাকে হৃদয়ের প্রশান্তি।

মূলত এটাই মানুষের প্রকৃত শান্তি, মুক্তি, কল্যাণ ও সাফল্যের পথ।

কুরআন মুক্তির পথ দেখায়

মানুষের এই প্রকৃত শান্তি, মুক্তি, কল্যাণ ও সাফল্যের বার্তা নিয়েই নাযিল হয়েছে ইসলামের মূল সূত্র আল কুরআন :

তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এক আলো এবং সুস্পষ্ট কিতাব। আল্লাহ এই কিতাবের মাধ্যমে ঐসব লোকদের শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টি সন্ধান করে এবং তিনি তাঁর নিজের মর্জিতে তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে আসেন। -সূরা ৫ আল মায়েদা : ১৫-১৬।

হাদিসে বলা হয়েছে :

আবি উমামা রা. বর্ণনা করেন, আমি রসূলুল্লাহ সা-কে বলতে শুনেছি: তোমরা কুরআন পাঠ করো। কিয়ামতের দিন কুরআন তার সাথিদের জন্যে মুক্তির সুপারিশকারী হিসেবে উপস্থিত হবে।

–সহীহ মুসলিম।

আরত্ত বলা হয়েছে,

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন : অবশ্যি এই কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে (উপাদেয় আত্মিক মানসিক খাদ্যের) দস্তরখান। তাই তোমাদের সাধ্যানুযায়ী আল্লাহর দস্তরখান থেকে (জ্ঞান) আহরণ করে। অবশ্যি এই কুরআন আল্লাহর রজ্জু, অনাবিল আলো এবং কল্যাণময় প্রতিকারক। যে কুরআনকে শক্ত করে ধরবে কুরআন তাকে রক্ষা করবে। যে কুরআনকে অনুসরণ করবে সে তার জন্যে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তির উপায় হবে।’ –হাকিম।

ইসলাম মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করে। যারা এই জীবনে ইসলামের মূল সূত্র আল কুরআন পড়বে, বুঝবে, অনুসরণ করবে এবং কুরআনকে আঁকড়ে ধরবে, পরজীবনে কুরআন তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাবে, তাঁদের মুক্তির ব্যবস্থা করবে।

 

কুরআন জীবন ও সমাজকে বদলে দেয়

কুরআন প্রসঙ্গে কুরআনের বাহক মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সা.-এর একটি বাণী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন :

আল কুরআন এমন একটি কিতাব যার সাহায্যে আল্লাহ কারো উত্থান ঘটান এবং কারো পতন ঘটান।

[সহীহ মুসলিম]

এর অর্থ কুরআন উত্থান পতনের নিয়ামক শক্তি। কুরআনকে ধারণ করলে কোনো জাতির উত্থান ঘটতে পারে। আবার কুরআনকে ছেড়ে দিলে কোনো জাতির পতন ঘটতে পারে। কথাটি ব্যক্তি এবং জাতির জন্যে সমভাবে প্রযোজ্য।

পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী, এই কুরআনই আরব উপত্যকার মেষ পালকদের বিশ্ববিজয়ী জাতির আসনে অধিষ্ঠিত করে দিয়েছিল। নিরক্ষর ক্রীতদাস, রাখাল, রাহাজন, মরু যাযাবর, গোত্রীয় কলহে বিধ্বস্ত এবং অজ্ঞতা ও অন্ধতায় নিমজ্জিত বিচ্ছিন্ন এক জনগোষ্ঠীকে এই কুরআনই শাশ্বত জ্ঞানে উদ্ভাসিত করে ঈমানের রজ্জুর নিবিড় বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছিল। এদেরকেই আল কুরআন জগত সেরা শাসক, দ্বিগি¦জয়ী সেনাপতি, অসীম সাহসী ন্যায় বিচারক, নির্ভীক দুঃসাহসী দূত, নিবেদিতপ্রাণ দায়ী ইলাল্লাহ এবং নির্যাতিত মানবতার প্রাণের বন্ধু বানিয়ে দিয়েছিল। এদেরকেই আল কুরআন বিশ্ব সেরা অধ্যাপক, দার্শনিক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, হাদিস বিশারদ, কুরআন ব্যাখ্যাতা, প্রকৌশলী ও সমরবিশারদ বানিয়ে দিয়েছিল। এরাই আবির্ভূত হয়েছিল মানবতার মুক্তিদূত হিসেবে।

এ কুরআন ইতিহাসের রোম সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে দিয়েছিল। এ কুরআনই পশ্চিমের রাবাত-কর্ডোভা থেকে পূর্বের ব্রুনাই-জাকার্তা পর্যন্ত এবং দক্ষিণ সাগরের সমগ্র উপকূল থেকে নিয়ে বরফে ঢাকা উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলোর মানব হৃদয়সমূহকে ঈমানের অনাবিল আলোতে উদ্ভাসিত করে তুলেছিল। সেই আলো ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ে সর্বখানে। এ কথাই কুরআনে বলা হয়েছে এভাবে :

নিশ্চয়ই এই কুরআন সেই পথ দেখায়, যা সব চাইতে সঠিক এবং টেকসই। সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৯।

আল কুরআন সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা

কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, আল কুরআন সম্পর্কে আমাদের সমাজে কল্পনা প্রসূত বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে। যেমন :

  • কুরআন একটি ধর্মগ্রন্থ। কুরআন মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ।
  • ধর্মগ্রন্থ হিসেবে কুরআন পাঠ করা সওয়াবের কাজ।
  • কুরআন বুঝা এবং শিক্ষা দেয়া আলেম ওলামার কাজ।
  • কুরআন ধর্মীয় মাসলা মাসায়েলের কিতাব।
  • কুরআন বুঝা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। সাধারণ মানুষের কুরআন বুঝার দরকার নেই, তাদের পক্ষে কুরআন বুঝা সম্ভব নয়।
  • কুরআন মহাপবিত্র কিতাব। সবাই সব সময় এটি স্পর্শ করতে পারে না, করলে পাপ হয়। অজু করে পবিত্র হয়ে জায়নামাযে বসে এটা তিলাওয়াত করতে হয়। সম্মানের সাথে জুযদানে মুড়িয়ে মাথার উপর রাখতে হয়।
  • কুরআন নামাযে পড়তে হয়, মরা মানুষের জন্যে পড়তে হয়, শবিনায় পড়তে হয়, খতম করলে সওয়াব হয়।
  • দোয়া, তাবিজ, ঝাড় ফুঁকে এ কিতাব ব্যবহার করলে উপকার হয়।
  • কুরআনের তফসির করা সাধারণের জন্যে নিষেধ। বুযুর্গ এবং বড় বড় আলেম উলামারা এটা করবেন।

এগুলো কুরআনের ব্যাপারে প্রচলিত ভুল ও সংকীর্ণ ধারণা। তবে এসব ভুল ও অসম্পূর্ণ ধারণার পরিবর্তন সূচিত হয়েছে এবং পরিবর্তন হতে থাকবে ইনশাল্লাহ। কারণ সত্য প্রকাশিত হবেই।

কুরআন পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা

তাহলে প্রশ্ন হলো কুরআন কেমন গ্রন্থ? কি কাজের গ্রন্থ কুরআন?

আসলে কুরআনের একজন সচেতন পাঠক কুরআন পড়লেই বুঝতে পারেন, কুরআন মানুষের জীবন যাপনের এক পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা, পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা এবং মানুষের মুক্তির পথ। আল কুরআনে রয়েছে :

১. সৃষ্টিতত্ত্ব। জীবন তত্ত্ব।
২. স্রষ্টার পরিচয় এবং তাঁর প্রতি মানুষের কর্তব্যের বিবরণ।
৩. স্রষ্টার ইবাদত (উপাসনা) বিধি।
৪. আত্মোন্নয়ন বা মানবসম্পদ উন্নয়নের নির্দেশিকা (Human resource development guide) ও উন্নত             নৈতিক গুণাবলীর বিবরণ।
৫. মানব জীবনের প্রকৃত সাফল্য ব্যর্থতার নির্দেশিকা।
৬. জীবন ব্যবস্থা। জীবন যাপনের ম্যানুয়েল।
৭. উপদেশ, সুসংবাদ ও সাবধানবাণী।
৮. হালাল ও হারামের বিবরণ।
৯. দাম্পত্য সম্পর্ক ও পারিবারিক বিধান।
১০. পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিবরণ।
১১. উত্তরাধিকার বিধান।
১২. দাওয়াত ও তবলিগের নির্দেশ ও পদ্ধতি।
১৩. ন্যায়নীতির প্রসার ও অন্যায় দুর্নীতির প্রতিবিধান পদ্ধতি।
১৪. সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিধান।
১৫. আইন ও বিচার বিধান।
১৬. অর্থনৈতিক বিধান।
১৭. সমর বিধান।
১৮. বৈদেশিক সম্পর্ক বিধি।
১৯. ইতিহাস।
২০. সর্বপ্রকার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য।
২১. মানুষের মুক্তি ও সাফল্যের পথ নির্দেশ।

দেখুন, আল কুরআন সম্পর্কে মহান আল্লাহর কয়েকটি সুস্পষ্ট ঘোষণা:

অর্থ : আমি এই কিতাবে কোনো বিষয়ই বাদ দেইনি।-সূরা ৬ আনআম : আয়াত -৩৮।

আমি তোমার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছি, যা প্রত্যেকটি বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনাদানকারী। -সূরা ১৬ নাহল : আয়াত ৮৯।

 

আল কুরআন মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে জাগরণ সৃষ্টি করে

মুলত ইসলামের মূল উৎস আল কুরআন নাযিল হয়েছে মানব সমাজের মুক্তির লক্ষ্যে পরিবর্তন সাধন করতে। কুরআন বিপ্লব ঘটায় :

১. মানুষের চিন্তা, দৃষ্টিভংগি ও মনের মধ্যে (মানসিক বিপ্লব),
২. মানুষের চরিত্র, আচরণ ও জীবন পদ্ধতির মধ্যে (চারিত্রিক বিপ্লব),
৩. মানুষের সমাজ পদ্ধতি ও সমাজ কাঠামোর মধ্যে (সমাজ বিপ্লব) এবং
৪. মানুষের আইন, বিচার ও শাসন পদ্ধতির মধ্যে (রাষ্ট্র বিপ্লব)।

ইসলামের মূল উৎস আল কুরআন মানবতার মুক্তির বার্তা। এই বার্তা মুক্তির দুর্জয় আলোকচ্ছটা তীর্যক বেগে নিক্ষেপ করে মিথ্যা বাতিল ও অন্যায় অসত্যের গাত্রদেহে। এই আঘাতের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় পরাভূত হয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় মিথ্যা বাতিলের বর্ণালি প্রাচীর। মহান আল্লাহ বলেন :

বরং আমি সত্য (আল কুরআন) দিয়ে মিথ্যা-বাতিলের উপর আঘাত হানি। ফলে তা মিথ্যাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয় এবং তাতে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। -সূরা ২১ আল আম্বিয়া : আয়াত -১৮।

মূলত কুরআন এই আঘাত হানে তার পাঠকের মন মস্তিষ্কে জমে থাকা বাতিল বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণার উপর। তার ভ্রান্ত ও বিকৃত চরিত্র ও আচরণের উপর। পর্যায়ক্রমে এ আঘাতের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় বাতিল সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর। এরই পরিণতিতে মানুষ মুক্ত হয় সকল ধরনের ধ্বংসকর শৃঙ্খল থেকে। মানুষ পায় মুক্তির সাধ এবং প্রশান্ত চিত্তে এগিয়ে চলে সাফল্যের পথে।

কুরআন দ্বারা মুক্তি ও সাফল্য লাভের শর্তাবলী

মুক্তি লাভ করা মানে- জীবনকে অজ্ঞতা, অনিশ্চয়তা, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধ, শাস্তি ও ধ্বংস থেকে মুক্ত করে জ্ঞান, শান্তি, নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, পবিত্রতা, প্রশান্তি ও সাফল্যের পথে পরিচালিত করা এবং ইহকালীন ও পরকালীন উভয় স্তরে জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করা। এর জন্যে প্রয়োজন পাঁচটি শর্ত পূরণ করা। সেগুলো হলো :

১. জ্ঞান (অর্থাৎ ধ্বংস ও মুক্তি এবং সাফল্য ও ব্যর্থতার পরিচয় ও পথ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান ও পথনির্দেশ লাভ করা)।
২. ঈমান (অর্থাৎ এক সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর নির্দেশিত বিষয়সমূহের প্রতি ঈমান আনা)।
৩. মুক্তির মরণপণ সংকল্প নিয়ে দুনির্বার গতিতে এগিয়ে চলা।
৪. পরিপূর্ণ জীবনকে মুক্তির পথে পরিচালিত করা।
৫. মুক্তি পথে পর্বতের মতো অটল অবিচল থাকা।

জীবনকে প্রকৃত মুক্তি ও সাফল্যের পথে পরিচালিত করার প্রক্রিয়া এটাই। এ প্রসঙ্গে দেখুন আল্লাহর বাণী :

অর্থ : তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে তোমার কাছে যা (যে কিতাব, জীবন ব্যবস্থা) নাযিল হয়েছে, যে ব্যক্তি তা সত্য বলে জানে, সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য- যে এ ব্যাপারে অজ্ঞ-অন্ধ? উপদেশ তো বুদ্ধিমান লোকেরাই গ্রহণ করে। -সূরা ১৩ আর রা’দ : আয়াত -১৯।

অর্থ : তোমরা মুখ করো পূর্ব কি পশ্চিম দিকে, তা কোনো প্রকৃত পুণ্যের ব্যাপার নয়। বরং প্রকৃত পুণ্যের কাজ হলো ঐ ব্যক্তির কাজ, যে ঈমান আনে আল্লাহর প্রতি, আখিরাতের প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি আল কিতাবের প্রতি এবং নবীগণের প্রতি। -সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ১৭৭।

অর্থ : মুমিনদের কিছু লোক আল্লাহর সাথে কৃত অংগিকার পূর্ণ করেছে, তাদের কিছু লোক শাহাদত বরণ করেছে আর কিছু লোক প্রতীক্ষায় রয়েছে। কিন্তু তারা তাদের নীতি পরিবর্তন করে নাই। -সূরা ৩৩ আহযাব : আয়াত ২৩।

অর্থ : হে ঈমানদারগণ, তোমরা পূর্ণরূপে ইসলামে দাখিল হও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। -সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২০৮।

অর্থ : যে সব লোক ঘোষণা করলো : ‘আল্লাহ আমাদের রব’ এবং তারা এ কথার উপর অটল হয়ে থাকলো, নিঃসন্দেহে তাদের জন্যে ফেরেশতা নাযিল হয়ে থাকে এবং তাদের বলতে থাকে, ভয় পেয়ো না, চিন্তা করো না; আর সেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে সন্তুষ্ট হও, তোমাদের নিকট যার ওয়াদা করা হয়েছে। -সূরা ৪১ হামিম-আস্ সাজদা : আয়াত ৩০।

অর্থ : যারা তাগুতের দাসত্ব প্রত্যাখ্যান করলো এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করলো, তাদের জন্যে সুসংবাদ, কাজেই হে নবী! সুসংবাদ দাও আমার এই দাসদের। -সূরা ৩৯ যুমার : আয়াত ১৭।

 

ইসলামের অনুসারীদের পার্থিব মুক্তি ও সাফল্য

এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদ সাক্ষ্য দিচ্ছে :

যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকর দ্বারা (আল্লাহর স্মরণ ও কুরআন দ্বারা) প্রশান্তি লাভ করে, আর জেনে রাখো আল্লাহর যিকর দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে থাকে। -সূরা ১৩ রা’দ : আয়াত ২৮।

যারা ঈমান আনে, আল্লাহ এক সুপ্রমাণিত ঘোষণার মাধ্যমে তাদেরকে ইহকাল এবং পরকালে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখেন। -সূরা ১৪ ইবরাহিম : আয়াত ২৭।

অর্থ : যারা ঈমান আনে, এবং ঈমানের সাথে কোনো প্রকার শিরকের সংমিশ্রণ ঘটায় না, তাদের জন্যে রয়েছে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা, মূলত তারাই সঠিক পথের লোক। -সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ৮২।

অর্থ : পুরুষ বা নারী যে-ই মুমিন অবস্থায় আমলে সালেহ করবে, অবশ্যি আমরা তাকে দান করবো (এই পৃথিবীতে) এক সুন্দর জীবন। -সূরা ১৬ : ৯৭।

অর্থ : জনপদের অধিবাসিরা যদি ঈমান আনতো এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো, তবে আমি আসমান ও যমিনের প্রাচুর্যের দ্বার খুলে দিতাম। -সূরা ৭ : আয়াত ৯৬।

 

ইসলামের অনুসারীদের পরকালীন মুক্তি ও সাফল্য

মুমিন পুরুষ ও নারীদের সাথে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, তাদের তিনি এমন জান্নাতসমূহ দান করবেন, যেগুলোর নিচে ঝরণাধারাসমূহ বহমান থাকবে এবং যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। ঐ চির সবুজ বাগানে তাদের থাকার জন্যে থাকবে সুন্দর আবাস। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করবে, এটাই বড় সাফল্য। -সূরা ৯ তাওবা : আয়াত ৭২।

কিয়ামতের দিন আল্লাহর কিতাব আমান্যকারীদের বলা হবে : আমার আয়াতসমূহ তোমার কাছে এসেছিল। কিন্তু তুমি তা মানতে অস্বীকার করেছিলে এবং তুমি অহংকার করেছিলে। আর তুমি কাফিরদের দলভুক্ত হয়েছিলে। আল্লাহর প্রতি যারা মিথ্যারোপ করেছে, তুমি কিয়ামতের দিন দেখবে, তাদের চেহারা কালো। অহংকারীদের জন্যে কি দোযখে যথেষ্ট যায়গা নেই? যারা তাদের সফলতার জন্যে সতর্ক জীবন যাপন করেছে, সেদিন তাদেরকে আল্লাহ নাজাত দিবেন। তাদেরকে কোনো মন্দই স্পর্শ করবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। -সূরা ৩৯ যুমার : আয়াত ৫৯-৬১।

অর্থ : তাদের আমলের বদলা হিসেবে তাদের জন্যে চোখ জুড়ানোর মতো যা কিছু লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা কোনো মানুষই জানে না। -সূরা ৩২ সাজদাহ : ১৭।

অর্থ : তোমার প্রতি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে যে কিতাব নাযিল হয়েছে, তাকে যে সত্য বলে জানে, সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে, যে অন্ধ? বুঝের লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে। যারা আল্লাহর সাথে কৃত অংগিকার পূর্ণ করে এবং কখনো অংগিকার /চুক্তি/প্রতিশ্রুতি ভংগ করেনা; যারা সেইসব সম্পর্ক অটুট অক্ষুণ রাখে, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক অটুট রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা তাদের প্রভুকে ভয় করে এবং (আখিরাতের) মন্দ হিসাবের ভয়ে ভীত থাকে। তাছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে তারা সবর অবলম্বন করে, সালাত কায়েম করে, আমার প্রদত্ত রিযিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে দান করে এবং মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিরোধ করে। এদের জন্যেই রয়েছে শুভ পরিণতি। তাহলো চিরস্থায়ী জান্নাত। তাতে আরো প্রবেশ করবে তাদের পরিশুদ্ধ জীবন যাপনকারী পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তান সন্তুতি। সকল দরজা দিয়ে সেখানে ফেরেশতা তাদের কাছে ছুটে আসবে। বলবে: “আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, কারণ আপনারা সবর করেছিলেন। আপনাদের পরিণতির ঘর কতো চমৎকার।” -সূরা ১৩ আর রা’দ : আয়াত ১৯-২৪।

 

মুক্তির পথ এক আল্লাহর ইবাদত ও খিলাফত

পৃথিবীতে এক আল্লাহর ইবাদত (দাসত্ব) করা এবং তাঁর প্রতিনিধিত্বের (খিলাফতের) দায়িত্ব পালন করা ছাড়া মানুষের মুক্তির কোনো পথ নেই। সে জন্যে ইবাদত ও খিলাফতের মর্ম ও তাৎপর্য পরিষ্কার থাকা জরুরি।

ইবাদত ও খিলাফত শব্দ দু’টি কুরআনের দু’টি পরিভাষা। শব্দ দু’টি কুরআন মজিদে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্য বুঝানোর জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে একটি একটি করে দু’টি বিষয় নিয়েই আমরা খুব সংক্ষেপে আলোচনা করবো।

১. ইবাদত-এর অর্থ

আরবি ইবাদত শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। এর মৌলিক অর্থ তিনটি :

১. পূজা বা উপাসনা করা (Worship)।
২. আনুগত্য করা, হুকুম পালন করা এবং বাধ্যতা ও নতি স্বীকার করা (Obedience, Submission)।
৩. দাসত্ব ও গোলামি করা (Slavery)।

এই তিনটির ভিত্তিতে ইবাদতের অর্থ আরো প্রশস্ত। আরো অনেক প্রাসংগিক ভাবধারা এর সাথে একীভূত। নিম্নোক্ত বিষয়গুলোও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত:

১. দোয়া, প্রার্থনা, ফরিয়াদ, আরাধনা, আবেদন নিবেদন ও মিনতি করা।
২. ভক্তি, শ্রদ্ধা, বিনয় প্রকাশ করা।
৩. ভজন ও গুণকীর্তন করা; পবিত্রতা ও অনাবিলতা প্রকাশ করা।
৪. উচ্চতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও অনন্যতা প্রকাশ করা।
৫. মাথা নত করা, আত্মসমর্পন করা।
৬. নিঃশর্তভাবে আইন ও ফায়সালা মেনে নেয়া।
৭. বিনীতভাবে নত ও বশিভূত থাকা।
৮. বিনা প্রতিবাদে হুকুম তামিল করা।
৯. মানত করা, উৎসর্গ করা।
১০. ত্রাণকর্তা ও ভাগ্যবিধাতা হিসেবে মান্য করা।

এই মৌলিক ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো প্রতিটি এককভাবেও ইবাদত এবং সব গুলো সামষ্টিকভাবেও ইবাদত। কেউ এই কাজগুলোর কোনো একটি করলেও সেটা ইবাদত এবং সবগুলো করলেও সেগুলো ইবাদত।
যে ব্যক্তি ইবাদত (عِبَادَت) করে, তাকে বলা হয় আব্দ (عَبْد)। আব্দ মানে- উপাসক, পূজারি, কীর্তনকারী, ইবাদতকারী, ভক্ত, ফরিয়াদী, প্রার্থনাকারী, নিবেদক, অনুগত, বাধ্যগত, দাস, সেবাদাস। আরবি ভাষায় আল্লাহর ইবাদতকারীকে বলা হয় ‘আবদুল্লাহ’।

২. ইবাদত সকল সৃষ্টির সৃষ্টিগত প্রাকৃতিক বিধান

সকল জীব এবং জৈব ও জড় সৃষ্টিই জন্মগত ও স্বভাবগতভাবে তাদের স্রষ্টার আব্দ বা ইবাদতকারী। তারা সবাই তাদের সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করে এবং তিনি যে পদ্ধতির ইবাদত তাদের স্বভাবজাত করে দিয়েছেন সে পদ্ধতিতেই তারা তাঁর ইবাদত করে। মহাবিশ্ব এবং পৃথিবী মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার দাস (আব্দ)। এ দুয়ের মধ্যে যারা আছে এবং যা কিছু আছে সবাই এবং সবকিছু তাঁর দাস (আব্দ)। তাঁর ইবাদত এবং দাসত্ব করার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করার কোনো অবকাশ তাদের নেই :

অর্থ : মূসা বললো : আমাদের রব তো তিনি, যিনি প্রতিটি জিনিসকে তার আকৃতি ও প্রকৃতি দান করেছেন অতপর (তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের) দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। -সূরা ২০ তোয়াহা : আয়াত ৫০।

অর্থ : অথচ মহাবিশ্ব এবং পৃথিবীতে যারা আছে, সকলেই ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করেছে। -সূরা ৩ আলে ইমরান : আয়াত ৮৩।

৩. ব্যতিক্রম শুধু জিন আর মানুষ

উপরোক্ত প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম শুধু জিন আর মানুষ। শয়তান জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ জিন আর মানব জাতিকে ইচ্ছার স্বাধীনতা (Freedom of will & choice) দিয়েছেন। সে কারণে শয়তান আল্লাহর হুকুম তামিল করতে অস্বীকার করেছিল। এই স্বাধীনতার কারণেই মানুষও আল্লাহর ইবাদত করতে অস্বীকার করে :

আর শয়তান তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। -সূরা ইসরা : আয়াত -২৭।

নিশ্চয়ই মানুষ অতিমাত্রায় যালিম এবং অবাধ্য। -সূরা ইবরাহিম : আয়াত -৩৪।

৪. মানুষ ও ইবাদত

মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদত করার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে দু’টি অবস্থা ও ব্যবস্থা সৃষ্টি করে দিয়েছেন :

১. প্রাকৃতিক বা জন্মগতভাবে মানুষ আল্লাহর দাস,
২. আল্লাহর দাস হবার ব্যাপারে সে স্বাধীন।

এ দু’টি অবস্থার কারণ হলো, মানুষের মধ্যে আল্লাহ দু’টি সত্তা সৃষ্টি করেছেন :

১. বস্তুগত সত্তা। অর্থাৎ তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও অন্যান্য বস্তুগত উপাদানসমূহ।
২. বুদ্ধিগত ও নৈতিক সত্তা। এর মধ্যে রয়েছে তার: intelligence, cognition. perception, sensation, ethics, judgment, feeling, will, choice, intention, desire, rationality, option, opinion, decisive power.

মানুষের বস্তুগত সত্তা জন্মগতভাবেই আল্লাহর দাস। মানুষের প্রতিটি অঙ্গ স্রষ্টার একান্ত অনুগত বাধ্যগত দাস। স্রষ্টা যে অঙ্গকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন এবং তার জন্যে যে ক্রিয়া/কর্ম (Function) নির্দেশ করেছেন, সে বিনীতভাবে কেবল সে নির্দেশই পালন করে যাচ্ছে। মানুষের চোখ, কান, নাসিকা, জিহ্বা, দন্ত, রক্ত, মস্তিষ্ক ইত্যাদি প্রতিটি অরগ্যানই নিষ্ঠার সাথে স্রষ্টার হুকুম তামিল করে যাচ্ছে। নিজের অরগ্যানসমূহের উপর মানুষের কোনো কর্তৃত্ব (Command) নেই। আপনি সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলেও আপনার চোখ দিয়ে শুনতে, কান দিয়ে দেখতে, পাকস্থলী দিয়ে চিন্তা করতে, মস্তিষ্ক দিয়ে খাদ্য হজম করতে, মুখ দিয়ে মূত্র ত্যাগ করতে, উপুড় হয়ে হাঁটতে, পা দিয়ে খেতে পারবেন না। কারণ, তারা আল্লাহর দাসত্ব করে, আপনার নয়।

কিন্তু পরম দয়াবান মহান আল্লাহ মানুষকে বস্তুগত সত্তার সাথে সাথে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাও দিয়েছেন এবং সে সত্তাটিকে স্বাধীন করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি মানুষকে দিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা (Freedom of will & freeom of choice)।

ফলে একজন ব্যক্তি কার বাধ্যগত থাকবে, কার হুকুম বিধান পালন করবে, কার কাছে নত থাকবে, কার কাছে প্রার্থনা করবে, কার আনুগত্য করবে, কার দাসত্ব করবে? কার উপাসনা করবে? -এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

কিন্তু তার এই প্রবণতাগুলো কাউকেও না কাউকেও অর্পণ করতেই হবে। অর্থাৎ কারো না কারো ইবাদত তাকে করতেই হবে। ইবাদত থেকে কোনো অবস্থাতেই সে মুক্ত থাকতে পারে না। কারণ ইবাদত করাই মানুষের প্রবণতাসমূহের স্রষ্টা প্রদত্ত প্রকৃতি।

৫. মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কার ইবাদত করে?

মানুষ আল্লাহ ছাড়া কার কার ইবাদত করে? এর জবাব হলো : যারা তাদের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে এক আল্লাহর ইবাদত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না, তারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, জ্ঞানের ভিত্তিতে বা অজ্ঞানতার কারণে, সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে ইবাদত করে :

১. তাদের সার্থেরও আত্মার কামনা বাসনার,
২. শয়তানের,
৩. তাগুতের (ক্ষমতাবান কর্তৃত্বের), মহাপুরুষদের,
৪. পূর্ব পুরুষের, প্রথা ও ঐতিহ্যের এবং
৫. মূর্তির ও মনগড়া উপাস্যদের।

এ প্রসঙ্গে দেখুন মহান আল্লাহর বাণী :

ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে তোমার মত কী, যে তার হাওয়াকে (আত্মার কামনা বাসনাকে) নিজের উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? তুমি কি তার উকিল হবে? -সূরা ২৫ আল ফুরকান : আয়াত ৪৩।

(ইবরাহিম তার পিতাকে আরো বলেছিলঃ) বাবা! শয়তানের ইবাদত করবেন না, কারণ শয়তান তো রহমানের অবাধ্য। -সূরা ১৯ মরিয়ম : আয়াত ৪৪।

হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দেইনি যে, শয়তানের ইবাদত করো না, কারণ সে তোমাদের সুস্পষ্ট শত্রু। -সূরা ইয়াসিন : আয়াত ৬০।

তাগুতের ইবাদত পরিহার করে এক আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশ প্রদানের জন্যে আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই রসূল পাঠিয়েছি। -সূরা ১৬ আন নহল : আয়াত ৩৬।

তাদের যখন বলা হতো : ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ করো।’ তখন তারা বলতো : ‘না, বরং আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে যে নিয়মের উপর পেয়েছি আমরা কেবল তারই অনুসরণ করবো।’ -সূরা বাকারা : ১৭০।

যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অলি হিসেবে গ্রহণ করে, তারা বলে : ‘আমরা তো তাদের ইবাদত করি এজন্যে, যাতে করে তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটে পৌঁছে দেয়। -সূরা ৩৯ যুমার : আয়াত ৩।

৬. মানুষকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে?

মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদত করতে এবং শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশই তাকে দেয়া হয়েছে :

হুকুম দানের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তিনি হুকুম দিয়েছেন: তোমরা ইবাদত করোনা একমাত্র তাঁর ছাড়া। -সূরা ১২ ইউসুফ : আয়াত ৪০।

পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যকে একমাত্র আল্লামুখী করে শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। -সূরা ৯৮ বাইয়্যেনা : আয়াত ৫।

হে মানুষ! তোমরা ইবাদত করো তোমাদের রবের, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের …। -সূরা ০২ বাকারা : আয়াত ২১।

তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকেই অংশীদার করো না। -সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ৩৬।

কোনো উপাস্য নেই আমি ছাড়া। সুতরাং তোমরা কেবল আমারই ইবাদত করো। -সূরা ২১ আম্বিয়া : আয়াত ২৫।

আমিই তোমাদের প্রভু। সুতরাং কেবল আমারই ইবাদত করো। -সূরা ২১ : আয়াত ৯২।

আর তোমরা কেবল আমারই ইবাদত করো, এটাই সিরাতুল মুস্তাকিম- সরল সঠিক পথ। -সূরা ৩৬ ইয়াসিন : আয়াত ৬১।

(ঈসা তার লোকদের বলেছিলঃ) নিশ্চয়ই আমার এবং তোমাদের প্রভু আল্লাহ। সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করো, এটাই সিরাতুল মুস্তাকিম। -সূরা ৩ আলে ইমরান : আয়াত ৫১।

যৌক্তিক দিক থেকেও আল্লাহর ইবাদত করাই মানুষের জন্যে সহজ সরল ও সঠিক। কারণ, মানুষের বস্তুগত সত্তা যেহেতু আল্লাহরই ইবাদত করে, তাই তার বুদ্ধিগত সত্তাও যদি আল্লাহরই ইবাদত করে, তবেই সমন্বয় (Harmony) সৃষ্টি হতে পারে তার দেহ ও মনের মধ্যে। আর এ সমন্বয় সৃষ্টির দ্বারাই তার পক্ষে শান্তি ও কল্যাণ লাভ করা সম্ভব। আর তার দেহ ও মনের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি না হলেই তার মধ্যে সৃষ্টি হবে অশান্তি। তার পরিণতি হবে অকল্যাণ আর ধ্বংস।

মানুষ যেনো নিজেকে অকল্যাণ ও ধ্বংস থেকে রক্ষা করে এবং কল্যাণ, শান্তি ও সাফল্যের পথ বেছে নেয়, সে জন্যেই Freedom of choice দিয়ে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে:

অর্থ : আমি জিন আর মানুষকে কেবল এজন্যেই সৃষ্টি করেছি, তারা যেনো (স্বেচ্ছায়) আমার ইবাদত করার পথই বেছে নেয়। -সূরা ৫১ যারিয়াত : আয়াত ৫৬।

 

৭. খিলাফত কী?

خِلاَفَة আরবি শব্দ। এর মূলخَلْف , আর خَلْف মানে- পেছনে আসা, পরে (next-এ) আসা, উত্তরাধিকারী হওয়া। خَلْف থেকেই গঠিত হয়েছে خِلاَفَة ও خَلِيْفَةٌ (খেলাফত ও খলিফা)। শব্দ দু’টির মৌলিক অর্থ হলো :

১. পেছনে আগত, স্থলাভিষিক্ত।

২. একের পর এক আগত দল।

৩. প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

৪. উত্তরসূরী/পরবর্তী অনুসারী।

৫. প্রতিনিধি/দায়িত্বপ্রাপ্ত।

৬. শাসক/কর্তৃত্বশীল।

 

৮. খলিফার কাজ কী?

খলিফা বা প্রতিনিধির কাজ কী? খলিফা বা প্রতিনিধির কার্যাবলী (Functions) সাধারণভাবে সকলেই জ্ঞাত ও অবহিত। মূলত খলিফার কার্যাবলী নিম্নরূপ :

১. মূল মালিকের বার্তা/আদেশ/নিষেধ/বিধান পৌঁছে দেয়া, জানিয়ে দেয়া এবং বুঝিয়ে দেয়া।

২. মূল মালিকের আনুগত্য করা, হুকুম পালন করা এবং তাঁর বাধ্যতা স্বীকার করার জন্য আহ্বান করা।

৩. মূল মালিকের বিরুদ্ধাচরণ না করার আহ্বান করা।

৪. মূল মালিকের অবাধ্যতা ও বিরুদ্ধাচরণের মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সকলকে সর্বপ্রকারে সতর্ক করা।

৫. মূল মালিকের ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি বিধান করলে পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করা।

৬. মূল মালিকের হুকুম-বিধান কার্যকর করা।

৭. মূল মালিকের ইচ্ছা ও আইন মোতাবেক শাসন পরিচালনা করা।

 

৯. আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে খলিফা বানিয়েছেন।

স্মরণ করো, যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বলেছিলেন : আমি পৃথিবীতে খলিফা বানাতে/নিযুক্ত করতে চাই। -সূরা ২ বাকারা : আয়াত ৩০।

প্রশ্ন হলো, এখানে ‘খলিফা’ মানে কি? এ আয়াতে উপরোক্ত ছয়টি অর্থের কোন্ অর্থটি গ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে মুফাসসিরদের মধ্যে মত পার্থক্য হয়েছে। তবে নিম্নোক্ত দু’টি মত অধিকতর যুক্তিসংগত ও অগ্রাধিকারযোগ্য :

১. এখানে ‘খলিফা’ শব্দটি সবগুলো অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
২. এখানে ‘খলিফা’ শব্দটি প্রতিনিধি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

বিশ শতকের সবচাইতে প্রাজ্ঞ তিনজন মুফাস্সির শহীদ সাইয়েদ কুতুব তাঁর তফসির ফী যিলালিল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর তফসির তাফহীমুল কুরআন এবং মুফতি মুহাম্মদ শফি তাঁর তফসির মা’আরিফুল কুরআনে শেষোক্ত দু’টি অর্থ অর্থাৎ প্রতিনিধি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থই গ্রহণ করেছেন।

১০. মানুষ কার খলিফা?

কুরআন মজিদ অধ্যয়ন করলে জানা যায়, মানুষ দায়িত্ব পালন করে-

১. আল্লাহর খলিফা হিসেবে, অথবা
২. শয়তানের খলিফা হিসেবে।

শয়তানের খলিফারা দাসত্ব, ইবাদত বন্দেগি ও তাবেদারি করে-

১. স্বয়ং শয়তানের,
২. নফসের (কামনা বাসনার),
৩. শয়তানি (অর্থাৎ পাপিষ্ঠ ও দুস্কৃতিকারী) নেতৃত্বের এবং
৪. রসম-রেওয়াজ, প্রথা প্রচলন ও পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের।

১১. আল্লাহর খলিফা হবার শর্ত

আল্লাহর খলিফা হবার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত পূরণ করতে হবে। এ তিনটি শর্ত পূরণ করা ছাড়া আল্লাহর খলিফা হওয়া যায় না। শর্ত তিনটি হলো :

১. আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা,
২. আল্লাহর দাসত্ব (ইবাদত) করা এবং
৩. ঈমান ও ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে কাউকেও শরিক না করা।

অর্থ : যারা ঈমান আনে গায়েব-এর প্রতি। -সূরা ০২ বাকারা : আয়াত ০৩।

অর্থ : তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকেও শরিক করো না। -সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ৩৬।

১২. আল্লাহর খলিফার কাজ

যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে এবং তাঁর বাধ্যতা ও দাসত্ব মেনে নিয়ে তাঁর খলিফা হয়, তাদের মূল কাজ হলো :

১. মানুষকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানানো:

অর্থ : তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রসূলের প্রতি এবং আমার অবতীর্ণ নূর (আল কুরআন)-এর প্রতি। -সূরা ৬৪ আত তাগাবুন : আয়াত ৮।

২. মানব সমাজকে অন্যদের ইবাদত বর্জন করে শুধুমাত্র এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান করা :

তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো। -সূরা ১৬ নহল : আয়াত ৩৬।

৩. আল্লাহর ইবাদতে কাউকে শরীক না করার আহ্বান জানানো :

তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর ইবাদতে কাউকেও শরিক করো না। -সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ৩৬।

৪. আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলার দাওয়াত দেয়া :

মানুষকে তোমার প্রভুর পথে (চলার) দাওয়াত দাও হিকমত ও মর্মস্পর্শী উপদেশের মাধ্যমে। -সূরা ১৬ আন নহল : আয়াত ১২৫।

৫. ভালো কাজের আদেশ দেয়া এবং মন্দ কাজে বাধা প্রদান করা:

তোমরা শ্রেষ্ঠ মানবদল, মানবজাতির কল্যাণে তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করো, মন্দ কাজে বাধা দাও। -সূরা ৩ আলে ইমরান : আয়াত ১১০।

৬. আল্লাহর দীন কায়েমের কাজ করা :

অর্থ : তোমরা দীনকে (ইসলামকে) কায়েম করো, আর এ ব্যাপারে একে অপর থেকে আলাদা হয়ো না। -সূরা ৪২ আশ শুরা, আতায়াংশ : ১৩।

৭. সত্য গ্রহণের উপদেশ দান এবং সত্যের উপর অটল থাকার নসিহত করা:

(তারা) একে অপরকে সত্য গ্রহণের উপদেশ দেয় এবং (সত্যের উপর) অটল থাকার উপদেশ দেয়। -সূরা ১০৩ আল আসর, আয়াতাংশ : ০৩।

৮. আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে শাসন কার্য ও বিচার ফায়সালা পরিচালনা করা :

হে দাউদ! আমি তোমাকে ভু-খণ্ডে খলিফা বানিয়েছি। কাজেই তুমি জনগণের মধ্যে সত্য দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করো এবং হাওয়া (নফস) -এর অনুসরণ করো না। -সূরা ৩৮ ছোয়াদ : আয়াত ২৬।

৯. ন্যায়পরায়ণ হওয়া ও মানব কল্যাণ করা :

আল্লাহ ন্যায়বিচার ও মানব কল্যাণের আদেশ দিচ্ছেন। -সূরা ১৬ : ৯০।

মানুষের প্রতি ইহসান করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি ইহসান করেছেন। -সূরা ২৮ আল কাসাস, আয়াতাংশ : ৭৭।

১০. দীনি আদর্শের বাস্তব নমুনা উপস্থাপন করা:

এমনি করে আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মাহ বানিয়েছি, যাতে করে তোমরা সকল মানুষের উপর সাক্ষী (নমুনা) হও। -সূরা ০২ : আয়াত ১৪৩।

১৩. ইবাদত ও খিলাফত : সারকথা

মূলতঃ ইবাদত হলো নিজে আল্লাহর দাসত্ব করা, আর খিলাফত হলো মানুষকে আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহ্বান করা। সংক্ষেপে ইবাদত ও খিলাফত হলো :

ক্রম ইবাদত খিলাফত
নিজে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা। মানুষকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানানো।
নিজে আল্লাহর সাথে কাউকেও অংশীদার না করা। আল্লাহর সাথে কাউকেও অংশীদার না করতে মানুষকে আহ্বান জানানো।
নিজে একনিষ্ঠভাবে এক আল্লাহর ইবাদত করা। মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের আহ্বান জানানো।
নিজে আল্লাহর দাস হওয়া। মানুষকে আল্লাহর দাস বানানো।
নিজে আল্লাহর দাস থাকা। মানুষকে আল্লাহর দাস রাখা।
নিজে আল্লাহর পথে চলা। মানুষকে আল্লাহর পথে চলার আহ্বান জানানো।
নিজে ভালো কাজ করা এবং মন্দ কাজ বর্জন করা। মানুষকে ভালো কাজ করার এবং মন্দ কাজ না করার আদেশ দেয়া।
নিজে আল্লাহর দীন কায়েমের কাজ করা। মানুষকে আল্লাহর দীন কায়েমের আহ্বান করা।
নিজে দীনের জ্ঞানার্জন করা। মানুষকে দীনের জ্ঞান দান করা।
১০ নিজে ন্যায়পরায়ণ হওয়া এবং সুবিচার করা। মানুষকে ন্যায় পরায়ন হতে এবং সুবিচার করতে আহ্বান জানানো।
১১ নিজে মানব কল্যাণ করা। মানুষকে মানব কল্যাণের আহ্বান জানানো।
১২ নিজে ন্যায় ও সত্যের উপর অটল থাকা। মানুষকে ন্যায় ও সত্যের উপর অটল থাকার উপদেশ দেয়া।
১৩ নিজে জান্নাতের পথে চলা। মানুষকে জান্নাতের পথে চলতে বলা।
১৪ নিজে জাহান্নামের পথ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর কাজ করা।
১৫ নিজে কুরআন সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। মানুষকে কুরআন সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার আহ্বান জানানো।

ইবাদত ও খিলাফতের মর্মবাণী অতীব সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে সূরা আল আসরে :

সময়ের শপথ! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্য ধারণে পরস্পরকে উদ্ধুদ্ধ করে।

এখানে ক্ষতি থেকে বাঁচার শর্ত হিসেবে ইবাদত ও খিলাফতের কথা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে।

বইঃ মুক্তির পথ ইসলাম
লেখকঃ আবদুস শহীদ নাসিম

 

ফেসবুকে যারা মন্তব্য করেছেনঃ

(Visited 864 times, 1 visits today)